আমরা জানি যে, ধর্মগ্রন্থে থাকে ধর্মের কথা। ঈশ্বরের কথা। দেব-দেবীর উপাখ্যান। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে নানা উপদেশ। তাই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে আমাদের কল্যাণ হয়।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ বা বেদসংহিতা। এছাড়া আছে উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চণ্ডী প্রভৃতি। এর আগে আমরা রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কে জেনেছি। এখন জানব বেদসংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, পুরাণ ও গীতা সম্পর্কে।
বেদসংহিতা : বেদ ঈশ্বরের বাণী। বিভিন্ন মুনি-ঋষি এই বাণীসমূহ দর্শন করেছেন। সেগুলো লিপিবদ্ধ করে সংহত করেছেন। তাই এর নাম হয়েছে সংহিতা বা বেদসংহিতা। বেদ প্রথমে একটিই ছিল। পরে ব্যাসদেব এর মন্ত্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেন। ফলে বেদ হয়ে যায় চারটি। চারটি বেদ হলো : ঋগ্বেদ সংহিতা, যজুর্বেদ সংহিতা, সামবেদ সংহিতা ও অথর্ববেদ সংহিতা।
ঋগ্বেদ সংহিতা - এতে রয়েছে দেবতাদের স্তুতি ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র। এগুলো পদ্যে - রচিত এক ধরনের কবিতা।
যজুর্বেদ সংহিতা- এতে যে মন্ত্রগুলো রয়েছে সেগুলো যজ্ঞের সময় উচ্চারণ করা হয় ।
সামবেদ সংহিতা - এর মন্ত্রগুলো গানের মতো। দেবতাদের উদ্দেশে এগুলো সুর দিয়ে গাওয়া হয় ।
অথর্ববেদ সংহিতা - এতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাস্তুবিদ্যা (গৃহ নির্মাণ) ইত্যাদিসহ জীবনের - অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
বেদের এক নাম শ্রুতি। এর কারণ, অতীতে শিষ্যরা গুরুর কাছ থেকে শুনে শুনে বেদ মনে রাখতেন। তাই এর এক নাম হয়েছে শ্রুতি। বেদের দুটি অংশ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ।
মন্ত্র : বেদের যে অংশ পদ্যে রচিত এবং বিভিন্ন দেবতার প্রশংসা, স্তুতি ও প্রার্থনা করা হয়েছে, তাকেই মন্ত্র বলা হয়েছে। যেমন— ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ।
ব্রাহ্মণ : যে অংশে মন্ত্রের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যজ্ঞে মন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে,তাকে বলে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ গদ্যে রচিত। ঐতরেয়, কৌষীতকি,শতপথ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থ।
আরণ্যক : যা অরণ্যে রচিত তা আরণ্যক। এর বিষয় ধর্ম-দর্শন। এতে যজ্ঞের চেয়ে সৃষ্টির রহস্য, সৃষ্টির উৎস প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে। ঐতরেয়, কৌষীতকি, শতপথ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য আরণ্যক।
উপনিষদ : এর আলোচ্য বিষয় ব্রহ্ম। ব্রহ্মের আরেক নাম পরমাত্মা। তিনি নিরাকার। প্রত্যেক জীবের মধ্যে তিনি বর্তমান। তাকে বলে জীবাত্মা। এ অর্থে জীবও ব্রহ্ম। ব্রহ্মই সবকিছুর মূলে। তাই উপনিষদে ব্রহ্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ঈশ, কেন, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য উপনিষদ।
পুরাণ : ‘পুরাণ' শব্দটির সাধারণ অর্থ প্রাচীন। কিন্তু এখানে শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। যে ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টি ও দেবতার উপাখ্যান, ঋষি ও রাজাদের বংশ-পরিচয় প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে, তাকে বলে পুরাণ। এসবের মাধ্যমে বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে।
পুরাণ একটি নয়, অনেকগুলো। মূল পুরাণ ১৮টি। উপপুরাণ ১৮টি। এগুলোর রচয়িতা ব্যাসদেব। কয়েকটি মূল পুরাণ হলো ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, অগ্নিপুরাণ ইত্যাদি। আর কয়েকটি উপপুরাণ হলো নরসিংহপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ ইত্যাদি।
পুরাণের মধ্যে তিনজন দেবতার মাহাত্ম্য প্রধানভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। দুর্গা ও কালীর বর্ণনা আছে যথাক্রমে দেবীপুরাণ ও কালিকাপুরাণে ।
গীতা : গীতার পুরো নাম শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি অংশ। এতে ১৮টি অধ্যায় আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইলেন না। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনেক উপদেশ দেন। সেটাই গীতা। গুরুত্বের কারণে এটি পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
গীতায় সব রকমের দুর্বলতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। ঈশ্বরের নামে সকল কর্ম করতে বলা হয়েছে। ফলের আশা না করে। একেই বলে নিষ্কাম কর্ম। আত্মার অমরত্বের কথা বলা হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলা হয়েছে। শ্রদ্ধাবান ও সংযমীরাই জ্ঞান লাভ করেন একথা বলা হয়েছে। গীতা হচ্ছে সব শাস্ত্রের সার। তাই এটি হিন্দুদের একখানা অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।
আমাদের ধর্মগ্রন্থসমূহে অনেক উপাখ্যান আছে। সেসব উপাখ্যানের মাধ্যমে ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এখানে ভাগবতপুরাণ থেকে হরিভক্ত ধ্রুবের উপাখ্যানটি তুলে ধরা হলো :
অনেক কাল আগের কথা। উত্তানপাদ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিলেন দুই রানি - সুনীতি ও সুরুচি। সুনীতি বড়, সুরুচি ছোট। সুনীতির পুত্র ধ্রুব, সুরুচির পুত্র উত্তম। ছোট রানি সুরুচি ছিলেন রাজার প্রিয়। তাই তাঁর পুত্র উত্তম পিতার কাছে বেশি আদর পেত ।
একদিন উত্তম পিতার কোলে বসে আছে। তা দেখে ধ্রুবও পিতার কোলে উঠতে যায়। ঠিক তখনই সুরুচি এসে বাধা দেন। এতে ধ্রুব খুব কষ্ট পেল। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে সব বলে দিল। মা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘কেঁদো না। হরিকে ডাক। তিনি তোমার সকল কষ্ট দূর করে দেবেন।
ধ্রুব মাকে খুব শ্রদ্ধা করত। তাই মায়ের আদেশ অনুযায়ী সে হরিকে ডাকতে লাগল। একদিন সে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। পথে যাকে দেখে তাকেই হরির কথা জিজ্ঞেস করে। এভাবে হরিনাম করতে করতে সে এক গভীর বনে ঢুকে পড়ল। তার মুখে হরিনাম শুনে বনের পশুরাও হিংসা ভুলে গেল ৷
ধ্রুব একমনে হরিকে ডেকেই চলেছে। অন্য কোনো দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার একমাত্র লক্ষ্য শ্রীহরির সাক্ষাৎ লাভ করা।
বালক ধ্রুবের এই একাগ্রতা দেখে শ্রীহরির মন গলে গেল। তিনি ধ্রুবের কাছে এসে দেখা দিলেন। বললেন, ‘ধ্রুব, তোমার তপস্যায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। '
ধ্রুব ভক্তিভরে শ্রীহরিকে প্রণাম করল। শ্রীহরি বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন। ধ্রুবও বাড়ি ফিরল। রাজা উত্তানপাদ দুহাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নিলেন। বড় হলে ধ্রুবকেই তিনি রাজা করলেন। মৃত্যুর পর ধ্রুবের স্থান হলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ স্থান ধ্রুবলোকে।
ধ্রুব উপাখ্যান থেকে আমরা এই নৈতিক শিক্ষা পাই যে, পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কারো সঙ্গে বিবাদ করা উচিত নয়। ভগবানকে ভক্তি করতে হবে। কোনো কিছু চাইলে একাগ্র মনে চাইতে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই তা লাভ করা যাবে। এ শিক্ষা আমরা সবসময় মনে রাখব এবং জীবনে পালন করব।
১। বিভিন্ন মুনি-ঋষি ___ বাণীসমূহ দর্শন করেছেন।
২। ___ শুধু ব্রহ্ম সম্পর্কে আলোচানা করা হয়েছে।
৩। ___ বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে।
৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ___ একটি অংশ ।
৫। ___ শুনে বনের পশুরাও হিংসা ভুলে গেল ৷
১। বেদের এক নাম ২। বৃহদারণ্যক একটি ৩। দুর্গার বর্ণনা আছে ৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অমরত্বের ৫। ধ্রুবের একমাত্র লক্ষ্য ছিল | দেবী পুরাণে । কথা বলা হয়েছে। আত্মার। উপনিষদ। শ্রীহরির সাক্ষাৎ লাভ । শ্রুতি। যোদ্ধার। |
১। বেদের এক নাম শ্রুতি হলো কেন?
২। আরণ্যক কী? দুটি আরণ্যকের নাম লেখ ।
৩। মূল পুরাণ কয়খানা? দুটি মূল পুরাণের নাম লেখ ৷
৪। গীতা কী?
৫। উত্তানপাদের কয়জন স্ত্রী ছিলেন? তাঁদের নাম লেখ ।
১। চার বেদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
২। ব্রাহ্মণ কী? সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
৩। উপনিষদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।
৫। ধ্রুব কীভাবে হরিকে পেল ?
আরও দেখুন...